শেয়ার বাজার ( Stock Market ): বাংলা ভাষায় বিনিয়োগের সহজ পাঠ

ফাইন্যান্স ভিশন
By -
0

শেয়ার বাজার ( Stock Market )



শেয়ার বাজার, যাকে আমরা স্টক মার্কেটও বলি, আধুনিক অর্থনীতির এক গুরুত্বপূর্ণ অংশ। অনেকে এখানে টাকা বিনিয়োগ করে লাভবান হন, আবার অনেকের জন্য এটা ঝুঁকিপূর্ণও বটে। তবে, সঠিক জ্ঞান কৌশল থাকলে, শেয়ার বাজার থেকে ভালো আয় করা সম্ভব। এই নিবন্ধে, আমরা শেয়ার বাজার সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করব, যাতে আপনি একজন সফল বিনিয়োগকারী হতে পারেন।


শেয়ার বাজার কী?


সহজ ভাষায়, শেয়ার বাজার হলো এমন একটি জায়গা, যেখানে বিভিন্ন কোম্পানির শেয়ার কেনা-বেচা করা হয়। শেয়ার মানে হলো একটি কোম্পানির মালিকানার অংশ। যখন আপনি কোনো কোম্পানির শেয়ার কেনেন, তখন আপনি সেই কোম্পানির কিছুটা মালিক হন।

ধরা যাক, একটি কোম্পানি তাদের ব্যবসা বাড়ানোর জন্য টাকা জোগাড় করতে চায়। তারা তাদের কোম্পানির কিছু অংশ শেয়ার হিসেবে বিক্রি করে। এই শেয়ারগুলো কেনেন বিনিয়োগকারীরা। এই কেনা-বেচার জায়গাটাই হলো শেয়ার বাজার।


শেয়ার বাজার কীভাবে কাজ করে?


শেয়ার বাজারের দাম বিভিন্ন কারণে ওঠানামা করে। কিছু গুরুত্বপূর্ণ কারণ হলো:


·         কোম্পানির লাভ-ক্ষতি: যদি কোনো কোম্পানি ভালো লাভ করে, তাহলে তাদের শেয়ারের দাম বাড়ে। আবার, ক্ষতি হলে দাম কমে যায়।

·         অর্থনৈতিক অবস্থা: দেশের অর্থনীতি ভালো থাকলে, শেয়ারের দাম সাধারণত বাড়ে। মন্দা চললে, দাম কমে যায়।

·         চাহিদা যোগান: যদি কোনো শেয়ারের চাহিদা বেশি থাকে, কিন্তু যোগান কম থাকে, তাহলে দাম বাড়ে। আবার, যোগান বেশি হলে দাম কমে।

·         বিনিয়োগকারীদের মনোভাব: খবর, রাজনীতি, এবং অন্যান্য ঘটনা বিনিয়োগকারীদের মনে প্রভাব ফেলে, যা শেয়ারের দামের ওপর প্রভাব ফেলে।

শেয়ার বাজারে বিনিয়োগের সুবিধা:

·         টাকা বাড়ানো: দীর্ঘমেয়াদে, শেয়ার বাজার অন্যান্য বিনিয়োগের চেয়ে বেশি লাভ দিতে পারে।

·         লভ্যাংশ আয়: কিছু কোম্পানি তাদের লাভের অংশ শেয়ারহোল্ডারদের মধ্যে ভাগ করে দেয়, যাকে লভ্যাংশ বলে।

·         বৈচিত্র্য: বিভিন্ন কোম্পানির শেয়ারে বিনিয়োগ করে, আপনি আপনার বিনিয়োগের ঝুঁকি কমাতে পারেন।


শেয়ার বাজারে বিনিয়োগের ঝুঁকি:


·         বাজারের অস্থিরতা: শেয়ারের দাম খুব দ্রুত ওঠানামা করতে পারে।

·         কোম্পানির ঝুঁকি: কোনো কোম্পানির ব্যবসা খারাপ হলে, শেয়ারের দাম কমে যেতে পারে।

·         অর্থনৈতিক ঝুঁকি: দেশের অর্থনীতি খারাপ হলে, শেয়ারের দাম কমে যেতে পারে।




বিনিয়োগের কৌশল:


শেয়ার বাজারে সফল হওয়ার জন্য কিছু কৌশল জানা দরকার।

1.    দীর্ঘমেয়াদী বিনিয়োগ: ভালো কোম্পানির শেয়ার কিনে দীর্ঘ সময়ের জন্য ধরে রাখা। এতে বাজারের ওঠানামা কম প্রভাব ফেলে।

2.    মূল্য বিনিয়োগ: কম দামে ভালো কোম্পানির শেয়ার কেনা। যখন দাম বাড়ে, তখন বিক্রি করে লাভ করা।

3.    বৃদ্ধি বিনিয়োগ: দ্রুত বাড়ছে এমন কোম্পানির শেয়ার কেনা। এই কোম্পানিগুলো ভবিষ্যতে আরও ভালো করতে পারে।

4.    লভ্যাংশ বিনিয়োগ: যে কোম্পানিগুলো নিয়মিত লভ্যাংশ দেয়, তাদের শেয়ার কেনা। এতে নিয়মিত আয় হয়।

5.    ডে ট্রেডিং: দিনের মধ্যেই শেয়ার কেনা-বেচা করা। এটা খুব ঝুঁকিপূর্ণ, কিন্তু দ্রুত লাভ করা সম্ভব।


ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা:


শেয়ার বাজারের ঝুঁকি কমাতে কিছু নিয়ম মানা উচিত।


·         বৈচিত্র্য: বিভিন্ন কোম্পানির শেয়ারে বিনিয়োগ করা। এতে কোনো একটি কোম্পানির ক্ষতি হলেও, বাকিগুলো ক্ষতি পুষিয়ে দিতে পারে।

·         স্টপ-লস অর্ডার: শেয়ারের দাম একটা নির্দিষ্ট পর্যায়ে এলে, স্বয়ংক্রিয়ভাবে বিক্রি করার অর্ডার দেওয়া। এতে বড় ক্ষতি থেকে বাঁচা যায়।

·         গবেষণা: শেয়ার কেনার আগে কোম্পানি বাজার সম্পর্কে ভালোভাবে জেনে নেওয়া।

·         ধৈর্য্য: শেয়ার বাজারে লাভ করতে সময় লাগে। ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করা দরকার।

·         আবেগ নিয়ন্ত্রণ: ভয় বা লোভের বশে শেয়ার কেনা-বেচা করা উচিত নয়।



বিনিয়োগ শুরু করার আগে যা জানা দরকার:


·         বিনিয়োগের লক্ষ্য: আপনি কেন বিনিয়োগ করতে চান? কত টাকা লাভ করতে চান?

·         ঝুঁকি নেওয়ার ক্ষমতা: আপনি কতটা ঝুঁকি নিতে পারবেন?

·         বিনিয়োগের সময়: কতদিনের জন্য বিনিয়োগ করতে চান?

·         বিনিয়োগের পরিমাণ: কত টাকা বিনিয়োগ করতে পারবেন?


বিনিয়োগের জন্য কিছু টিপস:

·         ছোট থেকে শুরু করুন: প্রথমে অল্প টাকা বিনিয়োগ করুন। অভিজ্ঞতা বাড়লে, পরিমাণ বাড়ান।

·         নিয়মিত বিনিয়োগ করুন: প্রতি মাসে বা প্রতি সপ্তাহে কিছু টাকা বিনিয়োগ করুন। এতে বাজারের ওঠানামা কম প্রভাব ফেলে।

·         শেখা চালিয়ে যান: শেয়ার বাজার সম্পর্কে সবসময় নতুন কিছু শিখতে থাকুন।

·         বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিন: প্রয়োজনে একজন অভিজ্ঞ বিনিয়োগকারীর পরামর্শ নিন।


শেয়ার বাজার বনাম অন্যান্য বিনিয়োগ:


·         ফিক্সড ডিপোজিট (Fixed Deposit): কম ঝুঁকি, নিশ্চিত লাভ, কিন্তু লাভ কম।

·         রিয়েল এস্টেট (Real Estate): দীর্ঘমেয়াদে ভালো লাভ, কিন্তু বেশি টাকা লাগে এবং সহজে বিক্রি করা যায় না।

·         সোনা (Gold): নিরাপদ বিনিয়োগ, কিন্তু লাভ কম।

·         মিউচুয়াল ফান্ড (Mutual Fund): বিশেষজ্ঞরা টাকা বিনিয়োগ করেন, ঝুঁকি কম, কিন্তু লাভ কম হতে পারে।

অবশ্যই, এখানে কিছু বিশ্ব এবং ভারতীয় শেয়ার বাজারের নাম এবং শেয়ারের নাম বাংলাতে দেওয়া হলো:



বিশ্ব শেয়ার বাজার:


·         নিউ ইয়র্ক স্টক এক্সচেঞ্জ (New York Stock Exchange - NYSE):

o    যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্ক শহরে অবস্থিত।

o    বিশ্বের অন্যতম বৃহত্তম শেয়ার বাজার।

o    উদাহরণস্বরূপ শেয়ার:

§  বার্কশায়ার হ্যাথাওয়ে (Berkshire Hathaway - BRK.A, BRK.B),

কোকা-কোলা (Coca-Cola - KO), ওয়ালমার্ট (Walmart - WMT)

·         নাসডাক (NASDAQ):

o    যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্ক শহরে অবস্থিত।

o    প্রযুক্তি কোম্পানির জন্য পরিচিত।

o    উদাহরণস্বরূপ শেয়ার:

§  অ্যাপল (Apple - AAPL), মাইক্রোসফট (Microsoft - MSFT),

অ্যামাজন (Amazon - AMZN), গুগল (Google - GOOG, GOOGL)

·         লন্ডন স্টক এক্সচেঞ্জ (London Stock Exchange - LSE):

o    যুক্তরাজ্যের লন্ডন শহরে অবস্থিত।

o    ইউরোপের অন্যতম প্রধান শেয়ার বাজার।

o    উদাহরণস্বরূপ শেয়ার:

§  শেল (Shell - SHEL), অ্যাস্ট্রাজেনেকা (AstraZeneca - AZN),

এইচএসবিসি হোল্ডিংস (HSBC Holdings - HSBA)

·         টোকিও স্টক এক্সচেঞ্জ (Tokyo Stock Exchange - TSE):

o    জাপানের টোকিও শহরে অবস্থিত।

o    এশিয়ার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ শেয়ার বাজার।

o    উদাহরণস্বরূপ শেয়ার:

§  টয়োটা মোটর কর্পোরেশন (Toyota Motor Corporation - 7203),

সনি গ্রুপ কর্পোরেশন (Sony Group Corporation - 6758)

·         সাংহাই স্টক এক্সচেঞ্জ (Shanghai Stock Exchange - SSE):

o    চীনের সাংহাই শহরে অবস্থিত।

o    বড় এবং বর্ধনশীল স্টক এক্সচেঞ্জ।

o    উদাহরণস্বরূপ শেয়ার:

§  কুইচৌ মাওতাই (Kweichow Moutai - 600519), ইন্ডাসট্রিয়াল ব্যাংক

(Industrial Bank - 601166)

ভারতীয় শেয়ার বাজার:

·         বোম্বে স্টক এক্সচেঞ্জ (Bombay Stock Exchange - BSE):

o    এশিয়ার প্রাচীনতম শেয়ার বাজারগুলোর মধ্যে একটি।

o    ভারতের মুম্বাই শহরে অবস্থিত।

o    প্রধান সূচক: সেনসেক্স (Sensex)

o    উদাহরণস্বরূপ শেয়ার:

§  রিলায়েন্স ইন্ডাস্ট্রিজ (Reliance Industries), টাটা কনসালটেন্সি সার্ভিসেস

(Tata Consultancy Services - TCS), স্টেট ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়া

(State Bank of India - SBI)

·         ন্যাশনাল স্টক এক্সচেঞ্জ অফ ইন্ডিয়া (National Stock Exchange of India - NSE):

o    ভারতের অন্যতম প্রধান শেয়ার বাজার।

o    ভারতের মুম্বাই শহরে অবস্থিত।

o    প্রধান সূচক: নিফটি ৫০ (Nifty 50)

o    উদাহরণস্বরূপ শেয়ার:

§  এইচডিএফসি ব্যাঙ্ক (HDFC Bank), ইনফোসিস (Infosys),

আইসিআইসিআই ব্যাঙ্ক (ICICI Bank), ভারতী এয়ারটেল (Bharti Airtel)


গুরুত্বপূর্ণ বিষয়:


·         স্টক প্রতীক (যেমন AAPL বা MSFT) প্রতিটি শেয়ারকে চিহ্নিত করে।

·         শেয়ার বাজারগুলো এই শেয়ারগুলো কেনা বেচার একটি প্ল্যাটফর্ম প্রদান করে।

·         অনেক বড় ভারতীয় কোম্পানি BSE এবং NSE উভয় জায়গাতেই তালিকাভুক্ত থাকে।

 

সাধারণ জিজ্ঞাসা:


·      নতুনদের জন্য শেয়ার বাজার কি নিরাপদ? - সঠিক জ্ঞান কৌশল থাকলে, নতুনরাও শেয়ার বাজারে বিনিয়োগ করতে পারেন।

·       কত টাকা দিয়ে শুরু করা যায়? - অল্প টাকা দিয়েও শুরু করা যায়।

·        শেয়ার কেনার সেরা সময় কখন? - দীর্ঘমেয়াদী বিনিয়োগের জন্য, সময় তেমন গুরুত্বপূর্ণ নয়। নিয়মিত বিনিয়োগ করাই ভালো।

·         কিভাবে শেয়ার কিনব? - ব্রোকারের মাধ্যমে শেয়ার কেনা যায়।


উপসংহার:

শেয়ার বাজার বিনিয়োগের একটি ভালো মাধ্যম, কিন্তু এর জন্য সঠিক জ্ঞান কৌশল দরকার। ধৈর্য, গবেষণা, এবং ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা জানা থাকলে, আপনি শেয়ার বাজার থেকে ভালো আয় করতে পারবেন। সবসময় মনে রাখবেন, বিনিয়োগের আগে ভালোভাবে জেনে নেওয়া জরুরি।

 


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)
3/related/default