টিডিএস এবং টিসিএস কী?
টিডিএস (ট্যাক্স ডিডাক্টেড অ্যাট সোর্স) এবং টিসিএস (ট্যাক্স কালেক্টেড অ্যাট সোর্স) হল ভারতের ইনকাম ট্যাক্স বিভাগের দুটি গুরুত্বপূর্ণ নিয়ম। টিডিএস মানে, আপনি যখন কাউকে পেমেন্ট করেন (যেমন বেতন, ভাড়া, বা সুদ), তখন একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ ট্যাক্স কেটে সরকারের কাছে জমা দিতে হয়। টিসিএস মানে, আপনি যখন কিছু বিক্রি করেন (যেমন পণ্য বা পরিষেবা), তখন ক্রেতার কাছ থেকে ট্যাক্স সংগ্রহ করে সরকারের কাছে জমা দিতে হয়।
২০২৫ সালের বাজেটে টিডিএস এবং টিসিএস নিয়মে বেশ কিছু পরিবর্তন এসেছে, যা ১ এপ্রিল, ২০২৫ থেকে কার্যকর হবে। এই পরিবর্তনগুলো সাধারণ মানুষ, ব্যবসায়ী এবং পেশাদারদের জন্য ট্যাক্স ফাইলিং সহজ করবে। আসুন, এই নতুন নিয়মগুলো বিস্তারিত জানি।
কেন এই পরিবর্তনগুলো এল?
সরকার চায় ট্যাক্স সিস্টেমকে আরও সহজ করতে। আগের নিয়মে অনেক সময় ব্যবসায়ীদের বাড়তি ঝামেলা হতো, যেমন ক্রেতার আয়কর রিটার্ন ফাইল করা হয়েছে কিনা তা যাচাই করা। এছাড়া, কিছু ট্যাক্স নিয়মের কারণে ছোট ব্যবসায়ীদের টাকা আটকে যেত। ২০২৫ সালের বাজেটে এই সমস্যাগুলো সমাধানের জন্য নতুন নিয়ম আনা হয়েছে। এই পরিবর্তনগুলোর মূল লক্ষ্য:
- ট্যাক্স ফাইলিং সহজ করা।
- ছোট ব্যবসায়ীদের টাকার প্রবাহ (ক্যাশ ফ্লো) বাড়ানো।
- অপ্রয়োজনীয় ট্যাক্স কাটা বন্ধ করা।
- আইনি ঝামেলা কমানো।
টিডিএস-এর নতুন নিয়ম (১ এপ্রিল, ২০২৫ থেকে)
টিডিএস নিয়মে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন এসেছে। এগুলো সাধারণ মানুষ এবং ব্যবসায়ীদের জন্য কীভাবে সুবিধা দেবে, দেখে নিই:
- ব্যাঙ্ক সুদের উপর টিডিএস সীমা বাড়ানো:
- সিনিয়র সিটিজেনদের জন্য: ব্যাঙ্কের ফিক্সড ডিপোজিট (এফডি) বা রেকারিং ডিপোজিট (আরডি) থেকে সুদের আয়ে টিডিএস সীমা বাড়িয়ে ৫০,০০০ টাকা থেকে ১ লাখ টাকা করা হয়েছে। অর্থাৎ, যদি আপনার সুদের আয় বছরে ১ লাখ টাকার নিচে হয়, তবে কোনও টিডিএস কাটা হবে না।
- অন্যদের জন্য: সাধারণ মানুষের জন্য এই সীমা ৪০,০০০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৫০,০০০ টাকা করা হয়েছে।
- ভাড়ার উপর টিডিএস সীমা: বাড়িওয়ালাদের জন্য ভাড়ার আয়ে টিডিএস সীমা বাড়িয়ে বছরে ২.৪ লাখ টাকা থেকে ৬ লাখ টাকা (মাসে ৫০,০০০ টাকা) করা হয়েছে। অর্থাৎ, যদি আপনার মাসিক ভাড়া ৫০,০০০ টাকার নিচে হয়, তবে ভাড়াটের কোনও টিডিএস কাটতে হবে না। এটা বাড়িওয়ালা এবং ভাড়াটেদের জন্য বড় সুবিধা।
- লটারি, ধাঁধা, ঘোড়দৌড়ের জয়ের উপর টিডিএস: আগে, বছরে মোট জয়ের পরিমাণ ১০,০০০ টাকার বেশি হলে টিডিএস কাটা হতো। এখন, প্রতিটি জয় ১০,০০০ টাকার বেশি হলেই টিডিএস কাটা হবে। উদাহরণ: যদি আপনি তিনবার ৮,০০০ টাকা করে জেতেন (মোট ২৪,০০০ টাকা), তবে কোনও টিডিএস কাটা হবে না, কারণ প্রতিটি জয় ১০,০০০ টাকার নিচে।
- ইনসিওরেন্স কমিশন: ইনসিওরেন্স এজেন্টদের কমিশনের উপর টিডিএস সীমা ১৫,০০০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ২০,০০০ টাকা করা হয়েছে। এর ফলে তাদের হাতে বেশি টাকা থাকবে।
- ডিভিডেন্ড এবং মিউচুয়াল ফান্ড: ডিভিডেন্ড বা মিউচুয়াল ফান্ডের আয়ে টিডিএস সীমা ৫,০০০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ১০,০০০ টাকা করা হয়েছে।
- পার্টনারশিপ ফার্মে নতুন নিয়ম (সেকশন ১৯৪টি): পার্টনারশিপ ফার্ম বা এলএলপি-তে পার্টনারদের পেমেন্ট (যেমন বেতন, কমিশন, সুদ) বছরে ২০,০০০ টাকার বেশি হলে ১০% হারে টিডিএস কাটতে হবে। এটা নতুন নিয়ম, যা পার্টনারদের আয়ের উপর ট্যাক্স সংগ্রহ নিশ্চিত করবে।
- সিকিউরিটাইজেশন ট্রাস্ট (সেকশন ১৯৪এলবিসি): সিকিউরিটাইজেশন ট্রাস্ট থেকে আয়ের উপর টিডিএস হার ২৫%-৩০% থেকে কমিয়ে ১০% করা হয়েছে। এটা বিনিয়োগকারীদের জন্য সুবিধা।
গুরুত্বপূর্ণ: সেকশন ২০৬এবি বাতিল করা হয়েছে। আগে, যদি কেউ আয়কর রিটার্ন না দিত, তবে তাদের থেকে বেশি হারে টিডিএস কাটা হতো। এখন এই নিয়ম নেই, ফলে ব্যবসায়ীদের ক্রেতার রিটার্ন ফাইলিং যাচাই করতে হবে না। এটা ট্যাক্স প্রক্রিয়াকে অনেক সহজ করবে।
টিসিএস-এর নতুন নিয়ম (১ এপ্রিল, ২০২৫ থেকে)
টিসিএস নিয়মেও বেশ কিছু পরিবর্তন এসেছে, যা ব্যবসায়ীদের জন্য সুবিধা নিয়ে এসেছে:
- পণ্য বিক্রির উপর টিসিএস বাতিল (সেকশন ২০৬সি(১এইচ)): আগে, ৫০ লাখ টাকার বেশি পণ্য বিক্রি হলে ০.১% হারে টিসিএস সংগ্রহ করতে হতো। এই নিয়ম ১ এপ্রিল, ২০২৫ থেকে বাতিল করা হয়েছে। এর ফলে ব্যবসায়ীদের ক্যাশ ফ্লো বাড়বে এবং কাগজপত্রের ঝামেলা কমবে।
- বিদেশে টাকা পাঠানোর সীমা: লিবারালাইজড রেমিট্যান্স স্কিম (এলআরএস) এবং বিদেশ ভ্রমণ প্যাকেজের জন্য টিসিএস সীমা ৭ লাখ টাকা থেকে বাড়িয়ে ১০ লাখ টাকা করা হয়েছে। অর্থাৎ, ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত টিসিএস কাটা হবে না।
- শিক্ষা লোনের উপর টিসিএস বাতিল: শিক্ষা লোনের মাধ্যমে বিদেশে টাকা পাঠালে কোনও টিসিএস কাটা হবে না। আগে, ৭ লাখ টাকার বেশি হলে ০.৫% টিসিএস কাটা হতো। এটা ছাত্র এবং তাদের পরিবারের জন্য বড় সুবিধা।
- বনজ সম্পদের উপর টিসিএস: কাঠ এবং অন্যান্য বনজ সম্পদের (তেঁতুল পাতা ছাড়া) উপর টিসিএস হার ২.৫% থেকে কমিয়ে ২% করা হয়েছে। এছাড়া, বনজ সম্পদের সংজ্ঞা ভারতীয় বন আইন, ১৯২৭ অনুযায়ী নির্ধারিত হবে।
- নন-ফাইলারদের জন্য টিসিএস: সেকশন ২০৬সিসিএ বাতিল করা হয়েছে। আগে, যারা আয়কর রিটার্ন ফাইল করত না, তাদের থেকে বেশি হারে টিসিএস কাটা হতো। এখন এই নিয়ম নেই, ফলে ব্যবসায়ীদের ক্রেতার রিটার্ন যাচাই করতে হবে না।
- টিসিএস জমা না দেওয়ার শাস্তি: আগে, টিসিএস সময়মতো জমা না দিলে ৩ মাস থেকে ৭ বছর পর্যন্ত জেল হতে পারত। এখন, যদি ত্রৈমাসিক টিসিএস স্টেটমেন্ট ফাইল করার সময়ের মধ্যে টাকা জমা দেওয়া হয়, তবে কোনও আইনি শাস্তি হবে না।
এই পরিবর্তনগুলো কাদের জন্য সুবিধা নিয়ে এসেছে?
নতুন নিয়মগুলো বিভিন্ন গোষ্ঠীর জন্য সুবিধা নিয়ে এসেছে:
- সিনিয়র সিটিজেন: ব্যাঙ্ক সুদের উপর টিডিএস সীমা বাড়ানোয় তাদের হাতে বেশি টাকা থাকবে।
- বাড়িওয়ালা: ভাড়ার উপর টিডিএস সীমা বাড়ানোয় ক্যাশ ফ্লো ভালো হবে।
- ছোট ব্যবসায়ী: পণ্য বিক্রির উপর টিসিএস বাতিল এবং নন-ফাইলার যাচাইয়ের ঝামেলা কমায় তাদের কাজ সহজ হবে।
- ছাত্র এবং অভিভাবক: শিক্ষা লোনের উপর টিসিএস বাতিল হওয়ায় বিদেশে পড়াশোনার খরচ কমবে।
- বিনিয়োগকারী: ডিভিডেন্ড, মিউচুয়াল ফান্ড, এবং সিকিউরিটাইজেশন ট্রাস্টের উপর কম টিডিএস হারে সুবিধা হবে।
কীভাবে প্রস্তুত হবেন?
নতুন নিয়ম মেনে টিডিএস এবং টিসিএস ফাইল করতে এই টিপসগুলো অনুসরণ করুন:
- অ্যাকাউন্টিং সফটওয়্যার আপডেট করুন: আপনার বিলিং বা অ্যাকাউন্টিং সফটওয়্যারে নতুন টিডিএস/টিসিএস সীমা এবং হার যোগ করুন।
- ট্যাক্স বিশেষজ্ঞের সাহায্য নিন: ছোট ব্যবসায়ী বা ব্যক্তিরা ট্যাক্স কনসালট্যান্টের পরামর্শ নিতে পারেন।
- সময়মতো ট্যাক্স জমা দিন: টিডিএস এবং টিসিএস নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে জমা না দিলে ১%-১.৫% হারে সুদ দিতে হবে।
- ইনকাম ট্যাক্স পোর্টাল চেক করুন: সরকারি নির্দেশিকা এবং আপডেটের জন্য নিয়মিত ইনকাম ট্যাক্স পোর্টাল দেখুন।
- রেকর্ড রাখুন: সব পেমেন্ট, টিডিএস, এবং টিসিএসের রেকর্ড সঠিকভাবে রাখুন, যাতে ফাইলিংয়ের সময় ঝামেলা না হয়।
কী করবেন না?
নতুন নিয়ম মানতে গিয়ে এই ভুলগুলো এড়িয়ে চলুন:
- পুরানো টিডিএস/টিসিএস হার ব্যবহার করবেন না।
- ট্যাক্স জমা দেওয়ার সময়সীমা মিস করবেন না, কারণ এতে সুদ এবং জরিমানা হতে পারে।
- নিজে থেকে নিয়ম বোঝার চেষ্টা না করে বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিন।
আপনার মতামত জানান
নতুন টিডিএস এবং টিসিএস নিয়ম নিয়ে আপনার কী মনে হচ্ছে? এই পরিবর্তনগুলো কি আপনার ব্যবসা বা ব্যক্তিগত আর্থিক পরিকল্পনায় সাহায্য করবে? নীচে কমেন্ট করে জানান। আরও ট্যাক্স-সম্পর্কিত তথ্য চাইলে আমাকে বলুন, আমি চেষ্টা করব সহজ ভাষায় তথ্য দিতে। ইনকাম ট্যাক্স পোর্টালে নিয়মিত চেক করুন এবং সময়মতো ট্যাক্স ফাইল করে জরিমানা এড়ান!