দক্ষিণ এশিয়ার অর্থনৈতিক ভবিষ্যৎ: ভারত কি নেতৃত্ব দেবে? (২০২০-২৬ জিডিপি বিশ্লেষণ)

ফাইন্যান্স ভিশন
By -
0

 

দক্ষিণ এশিয়ার অর্থনীতির গতিপথ: ২০২০-২৬ পর্যন্ত জিডিপি প্রবৃদ্ধির বিশ্লেষণ ও পূর্বাভাস

দক্ষিণ এশিয়া, বিশ্বের দ্রুত বর্ধনশীল অঞ্চলগুলির মধ্যে অন্যতম, তার বিশাল জনসংখ্যা এবং ক্রমবর্ধমান অর্থনীতির জন্য পরিচিত। সাম্প্রতিক বছরগুলিতে, বিশেষ করে ২০২০ সাল থেকে, এই অঞ্চলটি বৈশ্বিক অর্থনৈতিক ধাক্কা এবং অভ্যন্তরীণ চ্যালেঞ্জ উভয়ই মোকাবিলা করেছে। এই প্রবন্ধে আমরা ২০২০ থেকে ২০২৬ সাল পর্যন্ত দক্ষিণ এশিয়ার জিডিপি (Gross Domestic Product) প্রবৃদ্ধির গতিপথ বিশ্লেষণ করব, এর মূল চালিকা শক্তি, চ্যালেঞ্জ এবং ভারতের ভূমিকার উপর বিশেষ আলোকপাত করব।

দক্ষিণ এশিয়ার অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি

কোভিড-১৯ এর প্রভাব (২০২০-২০২১):

২০২০ সাল ছিল বিশ্ব অর্থনীতির জন্য একটি কঠিন বছর, এবং দক্ষিণ এশিয়াও এর ব্যতিক্রম ছিল না। কোভিড-১৯ মহামারীর কারণে এই অঞ্চলের অর্থনীতিতে তীব্র সংকোচন দেখা যায়। বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২০ সালে দক্ষিণ এশিয়ার গড় জিডিপি ৬.৫৮% হ্রাস পেয়েছিল। লকডাউন, সরবরাহ শৃঙ্খলে ব্যাঘাত এবং চাহিদা হ্রাসের কারণে ব্যবসা-বাণিজ্য মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তবে, ২০২১ সাল থেকে টিকাকরণ এবং অর্থনৈতিক কার্যকলাপ পুনরায় শুরু হওয়ার সাথে সাথে একটি প্রাথমিক পুনরুদ্ধার শুরু হয়।

পুনরুদ্ধার ও বর্তমান প্রবৃদ্ধি (২০২২-২০২৪):

২০২২ এবং ২০২৩ সালে দক্ষিণ এশিয়ার অর্থনীতিগুলি শক্তিশালীভাবে ঘুরে দাঁড়ায়। বিশেষ করে ভারত এবং বাংলাদেশ উচ্চ প্রবৃদ্ধি বজায় রাখে। অভ্যন্তরীণ চাহিদা, সরকারি বিনিয়োগ এবং রপ্তানি পুনরুদ্ধার এই প্রবৃদ্ধিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। ২০২৪ সালে, বিশ্বব্যাংকের পূর্বাভাস অনুযায়ী, দক্ষিণ এশিয়ার প্রবৃদ্ধি কিছুটা মন্থর হয়ে ৬.০ শতাংশে দাঁড়াতে পারে, যা বৈশ্বিক অনিশ্চয়তা এবং অভ্যন্তরীণ চ্যালেঞ্জের প্রভাবকে প্রতিফলিত করে।

ভবিষ্যৎ পূর্বাভাস (২০২৫-২০২৬):

বিশ্বব্যাংকের সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২৫ সালে দক্ষিণ এশিয়ার সম্মিলিত প্রবৃদ্ধি আরও কিছুটা মন্থর হয়ে ৫.৮ শতাংশে নেমে আসতে পারে, যা অক্টোবরের পূর্বাভাসের চেয়ে ০.৪ শতাংশ পয়েন্ট কম। তবে, ২০২৬ সালে এটি সামান্য বেড়ে ৬.১ শতাংশে উন্নীত হতে পারে বলে আশা করা হচ্ছে। এই পূর্বাভাসগুলি বিশ্ব অর্থনীতির অনিশ্চয়তা, অভ্যন্তরীণ রাজস্ব আদায়ে দুর্বলতা এবং জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবের মতো ঝুঁকির সম্মুখীন।

  • ভারত: ২০২৪-২৫ অর্থবর্ষে ভারতের প্রবৃদ্ধি ৬.৫ শতাংশ এবং ২০২৫-২৬ অর্থবর্ষে ৬.৩ শতাংশে মন্থর হতে পারে বলে অনুমান করা হচ্ছে।
  • বাংলাদেশ: ২০২৪-২৫ অর্থবর্ষে প্রবৃদ্ধি ৩.৩ শতাংশে নেমে আসতে পারে এবং ২০২৫-২৬ অর্থবর্ষে ৪.৯ শতাংশে উন্নীত হতে পারে।
  • শ্রীলঙ্কা: ঋণ পুনর্গঠনে অগ্রগতির কারণে ২০২৫ সালে ৩.৫ শতাংশ এবং ২০২৬ সালে ৩.১ শতাংশ প্রবৃদ্ধি আশা করা হচ্ছে।
  • পাকিস্তান: প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও মুদ্রাস্ফীতির ধাক্কা কাটিয়ে ২০২৪-২৫ সালে ২.৭ শতাংশ এবং ২০২৫-২৬ সালে ৩.১ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জনের সম্ভাবনা রয়েছে।
ভারতের অর্থনৈতিক প্রভাব

ভারতের ভূমিকা:

দক্ষিণ এশিয়ার অর্থনীতিতে ভারতের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ভারত এই অঞ্চলের বৃহত্তম অর্থনীতি, যা দক্ষিণ এশিয়ার মোট অর্থনীতির প্রায় ৮০% জুড়ে রয়েছে। এর শক্তিশালী অর্থনৈতিক কর্মক্ষমতা, বিশেষ করে পরিষেবা এবং শিল্প খাতে, আঞ্চলিক প্রবৃদ্ধির প্রধান চালিকা শক্তি হিসেবে কাজ করে। ভারতের অভ্যন্তরীণ চাহিদা এবং ক্রমবর্ধমান মধ্যবিত্ত শ্রেণী আঞ্চলিক বাণিজ্য ও বিনিয়োগের জন্য একটি বিশাল বাজার সরবরাহ করে। ভারতের অর্থনৈতিক উদারীকরণ নীতি এবং ডিজিটাল রূপান্তর এই অঞ্চলের অন্যান্য দেশগুলির জন্য একটি মডেল হিসেবে কাজ করতে পারে।

মূল চালিকা শক্তি ও চ্যালেঞ্জসমূহ:

দক্ষিণ এশিয়ার প্রবৃদ্ধির মূল চালিকা শক্তিগুলির মধ্যে রয়েছে তরুণ জনসংখ্যা, অভ্যন্তরীণ ভোগ বৃদ্ধি, অবকাঠামোতে বিনিয়োগ এবং ডিজিটাল অর্থনীতির প্রসার। তবে, এই অঞ্চলকে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হচ্ছে:

  • দুর্বল রাজস্ব আদায়: অনেক দেশে করের হার বেশি হলেও রাজস্ব সংগ্রহ দুর্বল, যা সরকারের আর্থিক অবস্থানকে ভঙ্গুর করে তোলে।
  • জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব: দক্ষিণ এশিয়ার প্রায় ৭৫ কোটি মানুষ জলবায়ু পরিবর্তনের হটস্পটে বাস করে, যা ফসল উৎপাদন হ্রাস, জল সংকট এবং স্থানচ্যুতির কারণ হচ্ছে।
  • বৈশ্বিক অনিশ্চয়তা: বিশ্ব অর্থনীতির মন্থরতা, ভূ-রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং বাণিজ্য বাধা আঞ্চলিক প্রবৃদ্ধিকে প্রভাবিত করতে পারে।
  • কৃষি খাতের পশ্চাৎপদতা: ঐতিহ্যবাহী কৃষি পদ্ধতি এবং অনানুষ্ঠানিক অর্থনীতির ব্যাপকতা প্রবৃদ্ধিকে সীমিত করছে।
  • উচ্চ ঋণ: অনেক দেশের উচ্চ বৈদেশিক ঋণ এবং সীমিত বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ আর্থিক স্থিতিশীলতার জন্য ঝুঁকি তৈরি করছে।



উপসংহার:

দক্ষিণ এশিয়া এখনও বিশ্বের দ্রুত বর্ধনশীল অঞ্চলগুলির মধ্যে একটি, তবে এর প্রবৃদ্ধির সম্ভাবনা ক্রমশ মন্থর হচ্ছে। স্থিতিশীল প্রবৃদ্ধি বজায় রাখতে এবং ভবিষ্যতের ধাক্কাগুলি মোকাবিলা করতে এই অঞ্চলের দেশগুলিকে অভ্যন্তরীণ রাজস্ব আদায় বৃদ্ধি, কর কাঠামো সংস্কার, কৃষি খাতের আধুনিকীকরণ এবং জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ নিতে হবে। ভারতের শক্তিশালী অর্থনৈতিক অবস্থান এবং আঞ্চলিক সহযোগিতা এই চ্যালেঞ্জগুলি মোকাবিলায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে, যা দক্ষিণ এশিয়ার অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ও সমৃদ্ধি নিশ্চিত করবে।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)
3/related/default