২০২৫ সালে সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প পুনরায় কঠোর শুল্কনীতি প্রয়োগের ঘোষণা দিয়েছেন, যেখানে আমদানি পণ্যের ওপর ৫০% পর্যন্ত ট্যারিফ আরোপের পরিকল্পনা রয়েছে। এই সিদ্ধান্ত ভারত ও যুক্তরাষ্ট্র উভয় দেশের জন্যই বড় অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি করতে পারে।
ভারতের জন্য এটি টেক্সটাইল, ইলেকট্রনিক্স এবং রত্ন-গয়না খাতে রপ্তানি কমিয়ে আনতে পারে, যার ফলে কর্মসংস্থান সংকট ও MSME (ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোগ) খাতে চাপ তৈরি হবে। অন্যদিকে, মার্কিন ভোক্তাদের জন্য দৈনন্দিন প্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বাড়বে এবং খুচরা বাজারে মুদ্রাস্ফীতি বাড়তে পারে।
এই প্রেক্ষাপটে দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্যিক সম্পর্ক, কূটনৈতিক চাপ এবং WTO পর্যায়ের বিরোধ নিষ্পত্তি প্রক্রিয়া নতুন মাত্রা পেতে চলেছে।
ভারতের
ওপর প্রভাব
- মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ভারতের রপ্তানি প্রায় ৮৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার (GDP-র ~২.৫%), যেখানে ২৫% শুল্ক থেকে বেড়ে ৫০% শুল্ক আরোপিত হবে, যা প্রধান সেক্টরের প্রতিযোগিতা নষ্ট করতে পারে।
- সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত রপ্তানি খাতসমূহ:
- রত্ন ও গয়না: ১০ বিলিয়ন ডলার রপ্তানিতে ৫২.১% শুল্ক, সুরাট ও মুম্বাইয়ের MSME শিল্প ঝুঁকিতে।
- টেক্সটাইল ও পোশাক: ১০.৮ বিলিয়ন ডলার, যেখানে বাংলাদেশ ও ভিয়েতনামে শুল্ক মাত্র ৩১%, ফলে রপ্তানি ৪০–৫০% কমতে পারে।
- সী-ফুড (চিংড়ি): ২.৪ বিলিয়ন ডলার রপ্তানিতে ৬০% মোট শুল্ক, বিশাখাপত্তনমের অ্যাকুয়াকালচার হুমকির মুখে।
- অটো কম্পোনেন্টস: ৩.৪ বিলিয়ন ডলার (২৫%) ও ৩.২ বিলিয়ন ডলার (৫০%) শুল্কে, গিয়ারবক্স ও ট্রান্সমিশন সরবরাহকারীদের লাভ কমছে।
- কেমিক্যালস: ২৫% রপ্তানি এখন জাপান ও কোরিয়ার কম শুল্কে তীব্র প্রতিযোগিতার সম্মুখীন।
- ম্যাক্রো অর্থনৈতিক ঝুঁকি ও প্রতিষ্ঠানভিত্তিক চাপ:
- জেপি মর্গান জানিয়েছে, এই ৫০% শুল্ক সরাসরি ভারতের প্রায় ১% GDP-কে ঝুঁকিতে ফেলবে এবং চাকরি ও কারেন্ট অ্যাকাউন্টের ওপর চাপ ফেলবে।
- ক্রিসিলের মতে, MSME খাত (ভারতের প্রায় ৪৫% রপ্তানির জন্য দায়ী) ক্ষতিগ্রস্ত হবে, মার্জিন ও মার্কেট শেয়ার হারাবে।
- সরকারি পদক্ষেপ ও প্রশমন:
- বাণিজ্য মন্ত্রণালয় MEIS-স্টাইল প্রণোদনা চালু করার পরিকল্পনা করছে, যা শুল্কের ১৫% পর্যন্ত বোঝা ভাগাভাগি করবে, ফলে কার্যকর হার ~২০%-এ নামানো সম্ভব।
- ইউরোপ, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ও আফ্রিকায় নতুন রপ্তানি বাজার খোঁজা হচ্ছে।
- রাশিয়ার সঙ্গে বাণিজ্য সম্পর্ক (রুপি-রুবল লেনদেন) বাড়ানো ও কিছু মার্কিন পণ্যে পাল্টা শুল্কের বিষয়টি বিবেচনায় আছে।
মার্কিন
যুক্তরাষ্ট্রের ওপর প্রভাব
- খরচ ও মূল্যস্ফীতি:
- ভারতীয় পোশাক, আসবাবপত্র, স্পোর্টস সামগ্রী, রত্ন ও গয়না আমদানিকারীরা ৫০% শুল্কে পড়বে, যার ফলে খুচরা দাম বেড়ে ভোক্তা মূল্যস্ফীতি বাড়বে।
- সরবরাহ শৃঙ্খল ব্যাহত হবে:
- ভারতীয় কেমিক্যাল, অটো পার্টস ও টেক্সটাইলের ওপর নির্ভরশীল প্রস্তুতকারকদের নতুন উৎস খুঁজতে হবে, যা উৎপাদন বিলম্ব ও লিড টাইম বাড়াতে পারে।
- সময়সীমা ও ছাড়:
- ২৭ আগস্ট রাত ১২:০১ (EDT)-এর আগে জাহাজে তোলা ও ১৭ সেপ্টেম্বরের মধ্যে ক্লিয়ার হওয়া পণ্য ছাড় পাবে।
- ইলেকট্রনিক্স ও স্মার্টফোন—বিশেষ করে ভারত-নির্মিত iPhone—এই পর্যায়ে শুল্কমুক্ত থাকছে।
ভারত
বনাম মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র: তুলনামূলক প্রভাব
প্রভাবের
মাত্রা |
ভারত |
মার্কিন
যুক্তরাষ্ট্র |
বাণিজ্য
ঝুঁকি |
৮৭
বিলিয়ন ডলারের রপ্তানি ঝুঁকিতে |
৮৭
বিলিয়ন ডলারের আমদানি ৫০% শুল্কে |
GDP ও
মুদ্রাস্ফীতি |
সরাসরি
প্রায় ১% GDP ক্ষতিগ্রস্ত |
খুচরা
মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধি |
সবচেয়ে
ক্ষতিগ্রস্ত খাত |
রত্ন,
টেক্সটাইল, সী-ফুড, অটো
যন্ত্রাংশ, কেমিক্যালস |
পোশাক,
আসবাব, কেমিক্যাল, গয়না, স্পোর্টিং গুডস |
প্রশমন
কৌশল |
নতুন
বাজার, MEIS প্রণোদনা, রাশিয়ার সঙ্গে বাণিজ্য বৃদ্ধি |
প্রি-ডেডলাইন ছাড়, টেক পণ্যের অস্থায়ী ব্যতিক্রম |
দীর্ঘমেয়াদে
এই ট্যারিফ যুদ্ধের ফলে উভয় দেশেই
বাণিজ্য প্যাটার্ন পরিবর্তন, সাপ্লাই চেইন পুনর্গঠন, এবং WTO-তে বিরোধ নিষ্পত্তির প্রচেষ্টা বাড়তে পারে। ভারত নতুন বাজার
ও সরকারি সহায়তা খুঁজছে, অন্যদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিকল্প উৎস বা দেশীয়
উৎপাদন বাড়ানোর পথে হাঁটছে।
পাবলিক ও রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া (সংক্ষিপ্ত )
- ভারত
- MSME
মালিক ও রপ্তানিকারকরা অর্ডার হারানো ও সম্ভাব্য ছাঁটাই নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।
- সাধারণ নাগরিকরা সরকারের নতুন বাজার খোঁজা ও সহায়তা প্রকল্পের পদক্ষেপকে সমর্থন করছেন।
- বিরোধী দলগুলো দ্রুত দ্বিপাক্ষিক আলোচনা ও WTO-তে অভিযোগ জানানোর দাবি জানিয়েছে।
- যুক্তরাষ্ট্র
- খুচরা বিক্রেতারা পোশাক, গৃহস্থালী সামগ্রী ও গয়নার বাড়তি দামের বিষয়ে সতর্ক করছেন।
- ভোক্তারা সামাজিক মাধ্যমে ক্ষোভ প্রকাশ করছেন কারণ “মেড ইন ইন্ডিয়া” পণ্যের দাম বেড়েছে।
- দুই দলের আইনপ্রণেতারা প্রশাসনকে সীমিত ব্যতিক্রমী শুল্ক নিয়ে আলোচনার আহ্বান জানিয়েছেন।
ভারত
ও যুক্তরাষ্ট্রের জন্য ভবিষ্যৎ সমাধান (সংক্ষিপ্ত )
- দ্বিপাক্ষিক আলোচনা
- শুল্ক, অশুল্ক বাধা এবং অনুবর্তন সমস্যাগুলো পর্যালোচনার জন্য যৌথ বাণিজ্য পরিষদ গঠন।
- টার্গেটেড শুল্ক ছাড়
- যেখানে ব্যাঘাত বেশি (যেমন: টেক্সটাইল, ইলেকট্রনিক্স) সেইসব পণ্যে ছাড় বা ধাপে ধাপে শুল্ক হ্রাসের জন্য আলোচনার উদ্যোগ।
- বাজার বৈচিত্র্য তহবিল
- রপ্তানিকারকদের নতুন বাজার খুঁজতে সাহায্য করার জন্য যৌথ অর্থায়নে বাণিজ্য মিশন ও ডিজিটাল প্রদর্শনী আয়োজন।
- সরবরাহ শৃঙ্খল স্থিতিস্থাপকতা অংশীদারিত্ব
- ঝুঁকি চিহ্নিত করে বিকল্প সরবরাহ কেন্দ্রগুলোতে যৌথ বিনিয়োগের জন্য পাবলিক-প্রাইভেট কনসোর্টিয়াম চালু।
- ডিজিটাল বাণিজ্য সহযোগিতা
- সীমান্তপারি ই-কমার্স দ্রুত করতে ই-ইনভয়েসিং, কাস্টমস-ক্লিয়ারেন্স প্রোটোকল ও ডেটা-নিরাপত্তা মানদণ্ড সমন্বয়।
- MSME
সক্ষমতা উন্নয়ন
- ক্ষুদ্র রপ্তানিকারকদের জন্য গুণমান মান, স্থায়িত্ব সার্টিফিকেশন এবং ফিনটেক সমাধানের প্রশিক্ষণে যৌথ অর্থায়ন।
- বিতর্ক নিষ্পত্তি প্রক্রিয়া
- বাণিজ্যিক বিরোধ দ্রুত সমাধানের জন্য WTO প্রক্রিয়াকে সম্পূরক করে ফাস্ট-ট্র্যাক সালিশি প্যানেল তৈরি।
- প্রযুক্তি ও গবেষণা সহযোগিতা
- টেকসই উৎপাদন, স্মার্ট লজিস্টিক্স এবং সবুজ সরবরাহ শৃঙ্খল প্রযুক্তিতে যৌথ গবেষণা স্পনসর।
ভারত-যুক্তরাষ্ট্রের উদীয়মান বাণিজ্য প্রতিবন্ধকতার প্রভাব
যেহেতু
শুল্ক ও অশুল্ক ব্যবস্থা
কঠোর হচ্ছে, উভয় দেশের ব্যবসা
ও ভোক্তারা চাপ অনুভব করছে।
জনমত বোঝা এবং সহযোগিতামূলক
সমাধান নির্ধারণ করা ব্যাঘাত কমিয়ে
দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যের গতি পুনরুদ্ধারের জন্য
গুরুত্বপূর্ণ হবে।
Path Forward: Collaborative Solutions
- দ্বিপাক্ষিক আলোচনা – শুল্ক সময়সূচি পর্যালোচনা, অনুবর্তন সহজীকরণ ও নিয়মিত আলোচনার ব্যবস্থা।
- টার্গেটেড শুল্ক ছাড় – গার্মেন্টস, মোবাইল উপাদান ইত্যাদিতে ধাপে ধাপে শুল্ক হ্রাস বা অস্থায়ী ছাড়।
- বাজার বৈচিত্র্য তহবিল – দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ও আফ্রিকার বাজারে প্রবেশের জন্য বাণিজ্য মেলা ও ডিজিটাল প্রদর্শনী।
- সরবরাহ শৃঙ্খল স্থিতিস্থাপকতা – বিকল্প লজিস্টিক্স হাব চিহ্নিত ও বিনিয়োগে সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্ব।
- ডিজিটাল বাণিজ্য সহযোগিতা – কাস্টমস প্রোটোকল, ই-ইনভয়েসিং ও ডেটা সিকিউরিটি মান সমন্বয়।
- MSME
সক্ষমতা বৃদ্ধি – সার্টিফিকেশন, টেকসই মান ও ফিনটেক সলিউশন নিয়ে প্রশিক্ষণ।
- দ্রুত বিরোধ নিষ্পত্তি – WTO-র দীর্ঘ প্রক্রিয়াকে সম্পূরক করতে দ্বিপাক্ষিক সালিশি প্যানেল।
- প্রযুক্তি ও গবেষণা সহযোগিতা – সবুজ উৎপাদন, স্মার্ট লজিস্টিক্স ও স্বয়ংক্রিয় কাস্টমস সিস্টেমে যৌথ গবেষণা।
উপসংহার
নীতিগত পরিবর্তন ও ব্যবসায়িক বাস্তবতার মধ্যে সেতুবন্ধন করতে কৌশলগত আলোচনা ও তাৎক্ষণিক রিলিফ পদক্ষেপ জরুরি। স্বল্পমেয়াদি ছাড় এবং দীর্ঘমেয়াদি ডিজিটাল ও সাপ্লাই-চেইন সহযোগিতা ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যকে নতুন সুযোগে রূপান্তর করতে পারে।