বাংলা শস্য বীমা হল পশ্চিমবঙ্গ সরকারের একটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ যা কৃষকদের প্রাকৃতিক দুর্যোগ, কীটপতঙ্গ এবং রোগের কারণে ফসলের ক্ষতি থেকে আর্থিক সুরক্ষা প্রদান করে। ২০১৯ সালে চালু হওয়া এই প্রকল্পটি কৃষকদের জীবিকা নিরাপদ রাখতে এবং তাদের কৃষি কার্যক্রম অব্যাহত রাখতে সহায়তা করে। এটি বিশেষভাবে পশ্চিমবঙ্গের বাঙালি কৃষকদের জন্য উপকারী, কারণ এটি রাজ্যের কৃষি চ্যালেঞ্জগুলির সমাধান করে।
প্রকল্পের উদ্দেশ্য :
বাংলা শস্য বীমা প্রকল্পের প্রধান উদ্দেশ্যগুলি হল:
- ফসলের ক্ষতি বা ক্ষয়ক্ষতির ক্ষেত্রে কৃষকদের আর্থিক সহায়তা প্রদান করা।
- আধুনিক কৃষি পদ্ধতি গ্রহণে কৃষকদের উৎসাহিত করা।
- বীমা প্রিমিয়ামের আর্থিক বোঝা কমিয়ে কৃষকদের সহায়তা করা।
মূল বৈশিষ্ট্য এবং সুবিধা :
বাংলা শস্য বীমা প্রকল্পটি কৃষকদের জন্য বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সুবিধা প্রদান করে:
- বিনামূল্যে বীমা: পশ্চিমবঙ্গ সরকার সম্পূর্ণ প্রিমিয়াম প্রদান করে, যা কৃষকদের জন্য বীমাটি বিনামূল্যে করে।
- ব্যাপক কভারেজ: এটি বিভিন্ন ধরনের ফসল কভার করে, যার মধ্যে প্রধান খরিফ এবং রবি ফসল রয়েছে, যা প্রতি বছর ঘোষণা করা হয়।
- কভারেজের ধরন:
- স্থায়ী ফসল (বপন থেকে ফসল কাটা): প্রাকৃতিক আগুন, বজ্রপাত, ঝড়, টেম্পেস্ট, সাইক্লোন, খরা, কীটপতঙ্গ এবং রোগের কারণে ফলনের ক্ষতি কভার করে।
- মধ্য-মরসুমের প্রতিকূলতা: ব্যাপক দুর্যোগের কারণে প্রত্যাশিত ফলন স্বাভাবিকের ৫০% এর কম হলে স্বস্তি প্রদান করে।
- ফসল কাটার পরবর্তী ক্ষতি: ফসল কাটার পর ২ সপ্তাহ পর্যন্ত ‘কাটা এবং ছড়ানো’ অবস্থায় শুকানো ফসলের জন্য সাইক্লোন, সাইক্লোনিক বৃষ্টি এবং অসময়ের বৃষ্টির বিরুদ্ধে কভারেজ।
- বপন/রোপণে বাধা: ঘাটতি বৃষ্টিপাত বা প্রতিকূল পরিস্থিতির জন্য সর্বোচ্চ ২৫% পর্যন্ত বীমা রাশি প্রদান করে।
- স্থানীয় ঝুঁকি: ঘোষিত এলাকায় বিচ্ছিন্ন খামারগুলির উপর শিলাবৃষ্টি, ভূমিধস এবং বন্যার প্রভাব কভার করে।
- প্রযুক্তি-চালিত: দাবি মূল্যায়নের জন্য উন্নত স্যাটেলাইট ইমেজারি এবং স্বয়ংক্রিয় আবহাওয়া স্টেশন ব্যবহার করে, যা দ্রুত এবং সঠিক ক্ষতিপূরণ নিশ্চিত করে।
- সরকারি সহায়তা: রাজ্য সরকার সম্পূর্ণ প্রিমিয়াম প্রদান করে, যা সকল কৃষকের জন্য প্রকল্পটিকে অ্যাক্সেসযোগ্য করে।
যোগ্যতার মানদণ্ড :
এই প্রকল্পটি পশ্চিমবঙ্গের সকল কৃষকদের জন্য উন্মুক্ত যারা ঘোষিত ফসল চাষ করছেন। এর মধ্যে রয়েছে ছোট, মাঝারি এবং বড় মাপের কৃষক, সেইসাথে ভাগচাষী এবং প্রজা কৃষক। ঋণগ্রহী কৃষকদের জন্য এই প্রকল্পে নথিভুক্তি বাধ্যতামূলক।
কভার করা ফসল :
প্রকল্পটি বিভিন্ন ফসল কভার করে, যা প্রতি বছর ঘোষণা করা হয়। উদাহরণস্বরূপ, রবি মরসুমে এটি বোরো (গ্রীষ্মকালীন) ধান, গম, রবি ভুট্টা, গ্রীষ্মকালীন ভুট্টা, ছোলা, মসুর, মুগ (গ্রীষ্মকালীন), সরিষা, তিল (গ্রীষ্মকালীন), চিনাবাদাম (গ্রীষ্মকালীন), আলু, আখ এবং খেসারি কভার করেছে। বর্তমান মরসুমের জন্য কভার করা ফসলের সর্বশেষ তালিকার জন্য কৃষকদের অফিসিয়াল পোর্টাল দেখতে হবে।
ফসল | মরসুম |
---|---|
বোরো (গ্রীষ্মকালীন) ধান | রবি |
গম | রবি |
রবি ভুট্টা | রবি |
গ্রীষ্মকালীন ভুট্টা | রবি |
ছোলা | রবি |
মসুর | রবি |
মুগ (গ্রীষ্মকালীন) | রবি |
সরিষা | রবি |
তিল (গ্রীষ্মকালীন) | রবি |
চিনাবাদাম (গ্রীষ্মকালীন) | রবি |
আলু | রবি |
আখ | রবি |
খেসারি | রবি |
কীভাবে আবেদন করবেন :
কৃষকরা অফিসিয়াল পোর্টাল (https://banglashasyabima.net/) অথবা স্থানীয় কৃষি অফিসের মাধ্যমে আবেদন করতে পারেন। আবেদনের জন্য প্রয়োজনীয় নথিগুলি হল:
- ভোটার আইডি কার্ড
- আধার কার্ড
- জমির রেকর্ড বিবরণ
- পট্টেদার পাসবুক
- জমির দখল সার্টিফিকেট
- চাষের প্রমাণ
- বীমা সার্টিফিকেট
- চুক্তি বা সম্মতি বিবরণ (ভাগচাষী এবং প্রজা কৃষকদের জন্য)
আবেদনের সময়সীমা ফসল এবং মরসুম অনুযায়ী পরিবর্তিত হয়। উদাহরণস্বরূপ, রবি ২০২৪-২০২৫ মরসুমের জন্য সময়সীমা ছিল:
- আলু, গম, ছোলা, মসুর, সরিষা, খেসারি, রবি ভুট্টা: ৩১ ডিসেম্বর, ২০২৪
- বোরো ধান: ৩১ জানুয়ারি, ২০২৫
- গ্রীষ্মকালীন ভুট্টা, গ্রীষ্মকালীন মুগ, গ্রীষ্মকালীন তিল, গ্রীষ্মকালীন চিনাবাদাম, আখ: ১৫ মার্চ, ২০২৫
প্রকল্পটি বার্ষিকভাবে আপডেট করা হয়, তাই কৃষকদের বর্তমান মরসুমের সময়সীমা এবং বিবরণের জন্য অফিসিয়াল ওয়েবসাইট দেখতে হবে।
দাবি প্রক্রিয়া :
ফসলের ক্ষতি বা ক্ষয়ক্ষতির ক্ষেত্রে, কৃষকরা অফিসিয়াল পোর্টালে (https://banglashasyabima.net/) "রিপোর্ট ক্রপ লস" বিকল্পে ক্লিক করে বা বীমা কোম্পানির হেল্পলাইনে তাদের পলিসি নম্বর সহ ক্ষতির বিষয়ে রিপোর্ট করতে পারেন। একজন বীমা কর্মকর্তা ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা পরিদর্শন করবেন, এবং মূল্যায়নের ভিত্তিতে ক্ষতিপূরণ সরাসরি কৃষকের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে জমা হবে।
সরকারি সহায়তা এবং প্রযুক্তি :
প্রকল্পটি সম্পূর্ণরূপে রাজ্য সরকার দ্বারা সমর্থিত, যা সম্পূর্ণ প্রিমিয়াম প্রদান করে, যা সকল কৃষকের জন্য প্রকল্পটিকে অ্যাক্সেসযোগ্য করে। এটি স্বচ্ছ এবং দক্ষ দাবি প্রক্রিয়াকরণ নিশ্চিত করতে স্যাটেলাইট ইমেজারি এবং স্বয়ংক্রিয় আবহাওয়া স্টেশনের মতো উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করে।
যোগাযোগের তথ্য :
কোনো প্রশ্ন বা সহায়তার জন্য, কৃষকরা নিম্নলিখিত মাধ্যমে যোগাযোগ করতে পারেন:
- টোল-ফ্রি হেল্পলাইন: ১৮০০২০৯৫৯৫৯
- ইমেল: bagichelp@bajajallianz.co.in
- স্থানীয় কৃষি অফিস
- বাংলা শস্য বীমা পোর্টাল: https://banglashasyabima.net/
এছাড়াও, স্থানীয় সহায়তার জন্য জেলাভিত্তিক বীমা কোম্পানির যোগাযোগ নম্বর পাওয়া যায়। নিম্নলিখিত টেবিলে কিছু জেলার যোগাযোগ নম্বর দেওয়া হল:
জেলা | যোগাযোগ নম্বর |
---|---|
আলিপুরদুয়ার | ০৬২৮৯৫৮৭২২৫ |
বাঁকুড়া | ০৮১১৬২৪২৭১৮ |
বীরভূম | ০৯৮০০৯০০৪৫৮ |
কোচবিহার | ০৬২৯৫৮৭৫৯১১ |
দক্ষিণ দিনাজপুর | ০৭৯০৮০৬৭৯০৬ |
দার্জিলিং | ০৮৯২৭২৬৯৮৬৬ |
হুগলি | ০৮০১৬৯৫৪৭৭৫ |
হাওড়া | ০৯৪৩৩৪২৪৪৩০ |
জলপাইগুড়ি | ০৮৯৭৪৪৭৯৯৩৭ |
ঝাড়গ্রাম | ০৭০০১২০৮৯২৯ |
কালিম্পং | ০৯০০৭৯৬৭০৬৬ |
মালদা | ০৯৪৭৫৯৮১৫৬০ |
মুর্শিদাবাদ | ০৯৮৫১৩২৯৯৮৪ |
নদিয়া | ০৯০০৭৯২৩৪১৯ |
উত্তর ২৪ পরগনা | ০৮২৪০০৬৩৮৭৫ |
পশ্চিম বর্ধমান | ০৯০০৭৭২১৩৫৬ |
পশ্চিম মেদিনীপুর | ০৯৭৩৫৪৫৫২৭৩ |
পূর্ব বর্ধমান | ০৯৭৩৪২৮১৪৩৯ |
পূর্ব মেদিনীপুর | ০৭৯০৮১১৩৫০৩ |
পুরুলিয়া | ০৭৫০১৩০৩৮৩৬ |
দক্ষিণ ২৪ পরগনা | ০৬২৯০৮৮৪২৫৪ |
উত্তর দিনাজপুর | ০৭০০৩৫৮২১৭৫ |
উপসংহার
কৃষিক্ষেত্রের অনিশ্চয়তা থেকে কৃষকদের রক্ষা করার জন্য পশ্চিমবঙ্গ সরকারের একটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ হল বাংলা শস্য বীমা প্রকল্প। বিনামূল্যে, ব্যাপক ফসল বীমা প্রদানের মাধ্যমে, এটি আর্থিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করে এবং টেকসই কৃষিকাজকে উৎসাহিত করে।
ফসল, সময়সীমা এবং দাবি সম্পর্কে সর্বশেষ তথ্যের জন্য কৃষকদের অফিসিয়াল পোর্টাল (https://banglashasyabima.net) এর মাধ্যমে আপডেট থাকার জন্য উৎসাহিত করা হচ্ছে।