আজকের বিশ্বে বিনিয়োগ শুধু টাকা বাড়ানোর মাধ্যম নয়, বরং একটি দায়িত্বশীল কাজ। পরিবেশ, সমাজ এবং শাসনব্যবস্থা (ESG) বিবেচনা করে বিনিয়োগ করা, যাকে ESG ইনভেস্টিং বলা হয়, এখন বিশ্বব্যাপী একটি বড় ট্রেন্ড। ভারতে এই ধারণা দ্রুত জনপ্রিয় হচ্ছে, বিশেষ করে ২০২৫ সালে যখন জলবায়ু পরিবর্তন, সামাজিক ন্যায়বিচার এবং কর্পোরেট গভর্নেন্সের মতো বিষয়গুলো আরও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। এই নিবন্ধে আমরা ESG ইনভেস্টিং-এর বিস্তারিত আলোচনা করব—এর অর্থ কী, সুবিধা-অসুবিধা, ভারতীয় প্রেক্ষাপটে এর বৃদ্ধি, উদাহরণ এবং কীভাবে আপনি এতে যোগ দিতে পারেন। চলুন শুরু করি।
![]() |
Image - Freepik |
ESG ইনভেস্টিং কী?
ESG ইনভেস্টিং হলো এমন একটি বিনিয়োগ কৌশল যেখানে কোম্পানিগুলোকে তাদের পরিবেশগত
(Environmental), সামাজিক (Social) এবং শাসনগত
(Governance) কর্মকাণ্ডের ভিত্তিতে মূল্যায়ন করা হয়। এটি শুধু আর্থিক লাভের উপর ফোকাস করে না, বরং কোম্পানিটি কীভাবে বিশ্বকে প্রভাবিত করছে তা বিবেচনা করে।
- Environmental (পরিবেশগত): এতে কোম্পানির পরিবেশের প্রতি দায়িত্ব দেখা হয়। উদাহরণস্বরূপ, কার্বন নির্গমন কমানো, পুনর্নবীকরণযোগ্য শক্তি ব্যবহার, জল সংরক্ষণ এবং বায়োডাইভার্সিটি রক্ষা। জলবায়ু পরিবর্তনের যুগে এটি খুব গুরুত্বপূর্ণ, কারণ কোম্পানিগুলো যদি পরিবেশ-বান্ধব না হয়, তাহলে ভবিষ্যতে তাদের ঝুঁকি বাড়বে।
- Social
(সামাজিক): এখানে কোম্পানির সমাজের প্রতি দায়িত্ব দেখা হয়। যেমন, কর্মীদের অধিকার, লিঙ্গ সমতা, সম্প্রদায়ের উন্নয়ন, স্বাস্থ্য-নিরাপত্তা এবং গ্রাহক সুরক্ষা। ভারতে, যেখানে সামাজিক অসমতা একটি বড় সমস্যা,
ESG এই দিকগুলোকে গুরুত্ব দেয়।
- Governance (শাসনগত): এতে কোম্পানির পরিচালনা ব্যবস্থা মূল্যায়ন করা হয়। যেমন, বোর্ডের স্বচ্ছতা, দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ, শেয়ারহোল্ডার অধিকার এবং নৈতিকতা। ভালো গভর্নেন্স থাকলে কোম্পানি দীর্ঘমেয়াদী সফলতা পায়।
ESG ইনভেস্টিং-এর সুবিধাসমূহ
ESG ইনভেস্টিং-এর অনেক সুবিধা আছে, যা বিনিয়োগকারীদের জন্য আকর্ষণীয় করে তোলে।
১. ঝুঁকি কমানো: ESG কোম্পানিগুলো পরিবেশ এবং সমাজের ঝুঁকি ভালোভাবে ম্যানেজ করে, যা দীর্ঘমেয়াদী স্থিতিশীলতা দেয়। উদাহরণস্বরূপ, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে যে কোম্পানিগুলো কার্বন-নির্ভর, তাদের ঝুঁকি বেশি। ESG বিনিয়োগ এই ঝুঁকি এড়ায়।
২. ভালো রিটার্ন: অনেক গবেষণায় দেখা গেছে যে ESG ফান্ডস ঐতিহ্যবাহী ফান্ডসের চেয়ে ভালো পারফর্ম করে। ২০২৫ সালে, ESG-ফোকাসড পোর্টফোলিওস উচ্চ রিটার্ন দেয় কারণ এগুলো উদ্ভাবনী এবং সাসটেইনেবল। ভারতে, ESG ফান্ডসের অ্যাসেটস ২০১৯ থেকে পাঁচ গুণ বেড়েছে।
৩. সামাজিক প্রভাব: আপনার বিনিয়োগ পরিবেশ রক্ষা, সামাজিক ন্যায় এবং ভালো গভর্নেন্সে সাহায্য করে। এটি বিনিয়োগকারীদের মানসিক সন্তুষ্টি দেয় এবং বিশ্বকে ভালো করে।
৪. নিয়ন্ত্রক সুবিধা: ভারতে SEBI এবং RBI ESG রিপোর্টিংকে বাধ্যতামূলক করছে, যা ESG কোম্পানিগুলোকে সুবিধা দেয়। ২০২৫ সালে, ESG-কমপ্লায়েন্ট কোম্পানিগুলো আরও ইনভেস্টর আকর্ষণ করবে।
৫. উদ্ভাবন উৎসাহিত করা: ESG বিনিয়োগ কোম্পানিগুলোকে নতুন প্রযুক্তি যেমন রিনিউয়েবল এনার্জি বা AI-ড্রিভেন সাসটেইনেবিলিটিতে বিনিয়োগ করতে উৎসাহিত করে।
৬. কনজিউমার প্রেফারেন্স: আজকের কনজিউমাররা ESG-সচেতন, তাই এমন কোম্পানিগুলো বেশি বিক্রি করে। ভারতে, মিলেনিয়াল এবং জেন Z বিনিয়োগকারীরা ESG-কে প্রাধান্য দেয়।
৭. গ্লোবাল ট্রেন্ডস: বিশ্বব্যাপী ইনভেস্টররা ESG-তে ফোকাস করছে, যা ভারতীয় কোম্পানিগুলোকে বিদেশী বিনিয়োগ আকর্ষণে সাহায্য করে। ২০২৫ সালে ভারতের আউটবাউন্ড ইনভেস্টমেন্টস ৬৭% বেড়েছে ESG-এর কারণে।
ESG ইনভেস্টিং-এর চ্যালেঞ্জস
যদিও সুবিধা অনেক, ESG-এর কিছু চ্যালেঞ্জও আছে।
১. গ্রিনওয়াশিং: কিছু কোম্পানি ESG-কে মার্কেটিং টুল হিসেবে ব্যবহার করে, কিন্তু আসলে তাদের কর্মকাণ্ড মিলে না। এটি বিনিয়োগকারীদের বিভ্রান্ত করে।
২. ডেটা অভাব: ESG মেট্রিক্স স্ট্যান্ডার্ডাইজড নয়, তাই কোম্পানিগুলোর তুলনা করা কঠিন। ভারতে, অনেক ছোট কোম্পানি ESG রিপোর্টিং করে না।
৩. শর্ট-টার্ম রিটার্ন: কখনও ESG বিনিয়োগ শুরুতে কম রিটার্ন দেয়, কারণ সাসটেইনেবিলিটিতে বিনিয়োগ করতে সময় লাগে।
৪. রেগুলেটরি কমপ্লেক্সিটি: বিভিন্ন দেশের ESG রুলস আলাদা, যা গ্লোবাল ইনভেস্টরদের জন্য চ্যালেঞ্জ। ভারতে, নতুন রুলস আসছে কিন্তু ইমপ্লিমেন্টেশন লাগবে।
৫. পারফর্ম্যান্স মেজারমেন্ট: ESG-এর প্রভাব মাপা কঠিন, কারণ এটি অ-আর্থিক।
তবুও, এই চ্যালেঞ্জস কাটিয়ে উঠতে নতুন টুলস এবং রেগুলেশনস আসছে।
ভারতে ESG ইনভেস্টিং-এর ট্রেন্ডস ২০২৫
ভারতে ESG দ্রুত বাড়ছে। ২০২৫ সালে, ESG অ্যাসেটস ১.৫৭ ট্রিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে। কয়েকটি ট্রেন্ড:
- রেগুলেটরি পুশ:
SEBI BRSR (Business Responsibility and Sustainability Reporting) বাধ্যতামূলক করেছে। ২০২৫ সালে, আরও কোম্পানি ESG
ডিসক্লোজার করবে।
- গ্রিন বন্ডস এবং ফিন্যান্স: গ্রিন বন্ডসের মাধ্যমে রিনিউয়েবল এনার্জিতে বিনিয়োগ বাড়ছে।
- আউটবাউন্ড ইনভেস্টমেন্টস: ভারতীয় কোম্পানিগুলো বিদেশে
ESG-ফোকাসড ইনভেস্টমেন্ট করছে, যা ৬৭% বেড়েছে।
- বায়োডাইভার্সিটি এবং AI: ২০২৫ সালে, নেচার এবং AI-এর সাথে ESG
যুক্ত হচ্ছে।
- ইনভেস্টর ইন্টারেস্ট: ভারতীয় ইনভেস্টররা ESG
ফান্ডসে আগ্রহী, বিশেষ করে রিনিউয়েবল এনার্জি এবং ক্লিন টেকে।
ভারতে ESG ফান্ডসের উদাহরণ
ভারতে অনেক ESG ফান্ড আছে।
ফান্ড নাম |
ফান্ড সাইজ |
ফোকাস |
SBI ESG
Exclusionary Strategy Fund |
₹৫,৬০৫ কোটি |
এক্সক্লুজনারি স্ট্র্যাটেজি, ভারতের সবচেয়ে বড়। |
Quantum
ESG Best In Class Strategy Fund |
₹১০৬ কোটি |
বেস্ট-ইন-ক্লাস কোম্পানি। |
Axis
ESG Integration Strategy Fund |
- |
ইন্টিগ্রেশন স্ট্র্যাটেজি। |
Aditya
Birla Sun Life ESG Fund |
- |
ESG ফোকাসড। |
ICICI
Prudential ESG Fund |
- |
প্রুডেন্সিয়াল ESG। |
Avendus
India ESG Fund |
- |
পরিবেশ এবং সামাজিক কজে ফোকাস। |
এগুলো CRISIL-এর মতো রেটিং এজেন্সি দিয়ে স্কোর করা যায়।
কীভাবে ESG ইনভেস্টিং শুরু করবেন
১. রিসার্চ করুন: ESG রেটিংস দেখুন (যেমন MSCI বা Sustainalytics)।
২. ফান্ডস বাছুন: উপরের উদাহরণ থেকে শুরু করুন।
৩. পোর্টফোলিও ডাইভার্সিফাই করুন: ESG-কে ট্রেডিশনাল বিনিয়োগের সাথে মিশান।
৪. প্রফেশনাল অ্যাডভাইস নিন: ফাইন্যান্সিয়াল অ্যাডভাইজারের সাহায্য নিন।
৫. মনিটর করুন: ESG রিপোর্টস ট্র্যাক করুন।
উপসংহার: ESG-এর ভবিষ্যত
ESG ইনভেস্টিং ভারতে একটি বিপ্লব আনছে। ২০২৫ সালে, এটি শুধু লাভের জন্য নয়, সাসটেইনেবল ভবিষ্যতের জন্য। যদি আপনি দায়িত্বশীল বিনিয়োগকারী হতে চান, তাহলে ESG-এ যোগ দিন। আরও তথ্যের জন্য, SEBI-এর ওয়েবসাইট বা ফাইন্যান্সিয়াল অ্যাডভাইজারের সাথে যোগাযোগ করুন। ভবিষ্যত ESG-এর!
ডিসক্লেইমার
এই নিবন্ধে প্রদত্ত তথ্য শুধুমাত্র সাধারণ তথ্য এবং শিক্ষামূলক উদ্দেশ্যে। এটি কোনো পেশাদার আর্থিক, বিনিয়োগ বা আইনি পরামর্শ নয়। আমরা কোনো ক্ষতি বা লোকসানের জন্য দায়ী নই যা এই তথ্যের উপর ভিত্তি করে ঘটতে পারে। বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে যোগ্য পেশাদারের সাথে পরামর্শ করুন।